২৮শে জুলাই, ১৯২০ খ্রীষ্টাব্দ। কোচবিহার কাপের খেলায় মুখোমুখি মোহনবাগান ও জোড়াবাগান। সেই সময়ে জোড়াবাগান দলের অন্যতম স্তম্ভ ছিলেন শৈলেশ বসু। তাঁকে ছাড়া সেই সময় দলগঠন ভাবাই যায় না। কিন্তু কোনো এক অজ্ঞাত কারণে মোহনবাগানের বিরুদ্ধে খেলায় দল থেকে বাদ দেওয়া হয় তাঁকে। পরে শোনা যায়,শুধু মাত্র বাঙাল হওয়ার কারণেই তাঁকে দল থেকে বাদ দেওয়া হয়। তখন জোড়াবাগান ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং চেয়ারম্যান ছিলেন সুরেশ চন্দ্র চৌধুরী। তিনি বারবার অনুরোধ করেন শৈলেশ বসুকে দলে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য। কিন্তু তাঁর কথায় কর্ণপাত করেননি কেউ। প্রচণ্ড অপমানিত হয়ে জোড়াবাগান ক্লাবের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেন সুরেশ চন্দ্র চৌধুরী। ঠিক করেন, আর নয়, এবার নতুন একটি ক্লাব গঠন করবেন। যাতে প্রাধান্য থাকবে পূর্ববঙ্গীয় অর্থাৎ বাঙালদের।
যেমন ভাবা, তেমন কাজ। সুরেশ চন্দ্র চৌধুরী, রমেশ চন্দ্র সেন, অরবিন্দ ঘোষ, শৈলেশ বসু মিলে গঠন করলেন নতুন ক্লাব। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন সন্তোষের মহারাজা মন্মথনাথ রায়চৌধুরী স্বয়ং। ১লা অগস্ট, ১৯২০ তে এই নতুন ক্লাবের প্রথম আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়। ভবিষ্যৎ কার্যকলাপ নিয়েও আলোচনা হয়। কিন্তু ক্লাবের একটা নাম তো দিতে হবে। কি নাম দেওয়া যায় ভাবতে ভাবতে হঠাৎই শৈলেশ বসু ইস্টবেঙ্গল নামটি প্রস্তাব করেন। প্রথমে কেউ রাজি হননি। পরে অবশ্য এই নামটিই গ্ৰহণ করা হয়।
নাম তো হল। কর্মসমিতিও গঠন হল। ঠিক হল, এই ক্লাব এখন থেকে আইএফএ আয়োজিত সমস্ত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবে। কিন্তু কি রঙের জার্সি পড়ে খেলবে এই দল? বহু চিন্তা ভাবনার পরেও ঠিক করে উঠতে পারলেন না কেউ।
এর মধ্যে একদিন সুরেশ বাবু একদিন রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলেন। হাঁটতে হাঁটতে একটি দোকানের দিকে দৃষ্টি পড়ে তাঁর। দেখেন, লাল আর হলুদ রঙের একটি জার্সি টাঙানো রয়েছে। দেখা মাত্রই সুরেশ বাবু ঠিক করেন, এই জার্সিটাই চাই। সেইমতো দোকানদারকে দাম জিজ্ঞাসা করেন। কিন্তু দোকানদার বলেন যে সাহেবদের কোন ক্লাব ওই জার্সি ইতিমধ্যেই পছন্দ করে গেছেন। তাছাড়া ওই জার্সির দামও বেশি। কিন্তু কোন ওজর আপত্তিই শুনলেন না সুরেশ বাবু। শেষ পর্যন্ত বেশি দাম দিয়েই লাল হলুদ রঙের ওই জার্সি কিনে নেন তিনি। পরে ক্লাবের অন্যান্য সদস্যদের দেখালে তাঁদেরও ওই জার্সি দারুণ পছন্দ হয়।
কিছু দিন পরেই সেই জার্সি গায়ে ইস্টবেঙ্গল দলের খেলোয়াড়রা হারকিউলিস কাপ খেলতে নামেন। এবং প্রথম টুর্নামেন্টে খেলতে নেমেই চ্যাম্পিয়ন হয় ইস্টবেঙ্গল ক্লাব। এরপর দুর্দান্ত পারফরম্যান্সকে হাতিয়ার করে
কলকাতা ফুটবল লীগের দ্বিতীয় ডিভিশনে জায়গা আদায় করে নেয় তাঁরা। ১৯২৪এ অসাধারণ ফুটবল খেলে তারা কলকাতা ফুটবল লীগের দ্বিতীয় ডিভিশনের শীর্ষস্থান দখল করে ব্রিটিশ রেজিমেন্টের দল ক্যামেরন 'বি' এর সাথে যুগ্মভাবে। ক্যামেরনের অন্য একটি দল ইতিমধ্যেই প্রথম ডিভিশনে নিয়মিত খেলে। ফলে তাঁদের নতুন করে প্রথম ডিভিশনে যোগ্যতা অর্জন করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তাই তারা নাম প্রত্যাহার করে। স্বাভাবিক ভাবেই ইস্টবেঙ্গল যোগ্যতা অর্জন করে কলকাতা লীগের প্রথম ডিভিশনে খেলার।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, যোগ্যতা অর্জন করা স্বত্ত্বেও ইস্টবেঙ্গলকে প্রথম ডিভিশনে উত্তীর্ণ করার ক্ষেত্রে অনেকেই বিরোধিতা করেন। তখন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সভাপতি রাজা মন্মথনাথ রায়চৌধুরী পত্র লিখে ইস্টবেঙ্গল কে প্রথম ডিভিশন লীগে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান। পরবর্তীকালে প্রথম ডিভিশনের আটটি বিদেশী তথা ইউরোপীয় দল ইস্টবেঙ্গলকে প্রথম ডিভিশনে উত্তরণের পক্ষে মতামত দেয়। দুটি দল বিরোধিতা করে। অবাক করার মত বিষয় হল, সেই দুই দল ছিল মোহনবাগান ও এরিয়ান। শেষ পর্যন্ত গরিষ্ঠ সংখ্যক দল পক্ষে কথা বলার ফলে প্রথম ডিভিশনে উত্তীর্ণ হয় ইস্টবেঙ্গল।
এত কম সময়ে কলকাতা লীগের প্রথম ডিভিশনে উত্তরণ! তার ওপর চূড়ান্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে। কেউ বোধহয় কল্পনাও করতে পারেননি। কিন্তু এটাই ইস্টবেঙ্গল। জন্মের পর থেকে এভাবেই একের পর এক বাধার সোপান অতিক্রম করে এগিয়ে চলতে থাকে তারা। এবং শুধু এগিয়ে চলাই নয়, ক্লাবকর্তাদের অদম্য ইচ্ছাশক্তির দরুণ একের পর এক সাফল্যও আসতে শুরু করে। ২৫শে মে, ১৯২৫। আরও এক ঐতিহাসিক দিন, কলকাতা তথা ভারতীয় ফুটবলে। যে মোহনবাগান শুধু মাত্র পূর্ববঙ্গীয় দল হওয়ার কারণে ইস্টবেঙ্গলের প্রথম ডিভিশনে খেলার বিরোধিতা করে, ইতিহাসে প্রথমবার খেলার মাঠে তাদের মুখোমুখি হলো ইস্টবেঙ্গল। এবং নোংরা রাজনীতির জবাব খেলার মাঠেই দেয় ইস্টবেঙ্গল। নেপাল চক্রবর্তীর করা একমাত্র গোলে মোহনবাগানকে পরাজিত করে তারা। সেই সময় থেকেই আস্তে আস্তে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে শুরু করে ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগান।
১৯৩০ খ্রীষ্টাব্দে গান্ধীজির সত্যাগ্ৰহ আন্দোলনের সময়ে সমস্ত ভারতীয় দল কলকাতা লীগ থেকে নাম তুলে নেয়।
কিন্তু এরপর যে কান্ড ঘটে, তা অভাবনীয়। আইএফএ পয়েন্ট তালিকায় প্রথম স্থানে না থাকা স্বত্ত্বেও রয়াল
রেজিমেন্টকে কলকাতা লীগের প্রথম ডিভিশনের চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করে এবং কোনো কারণ ছাড়াই
ইস্টবেঙ্গলকে দ্বিতীয় ডিভিশনে নামিয়ে দেয়। প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন লাল হলুদ সমর্থকরা। হাজার
হাজার ইস্টবেঙ্গল সমর্থক রাস্তায় নামেন হাতে জ্বলন্ত মশাল নিয়ে। শেষ পর্যন্ত চাপে পড়ে আইএফএ বাধ্য হয়
ইস্টবেঙ্গলকে প্রথম ডিভিশন লীগে উত্তীর্ণ করতে। ক্লাবের সমর্থকদের সেই লড়াইকে সম্মান জানিয়ে মশালকে ক্লাবের প্রতীক হিসাবে স্বীকৃতি দেন তৎকালীন কর্মকর্তারা।
প্রতিটি পদক্ষেপে এইভাবেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব ও তার সমর্থকরা। চাপের কাছে
কোনদিন ও মাথা নত করেননি তাঁরা। আর তাই ইস্টবেঙ্গল সম্পর্কে বলা হয়, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে তারা বাঘ হয়ে যায়। এই নাছোড় মনোভাবের প্রভাব খেলার মাঠেও পড়ত। ১৯৪২এ প্রথমবার কলকাতা লীগ জয় করে ইস্টবেঙ্গল। পরের বছর তারা প্রথমবারের জন্য আইএফএ শিল্ডে চ্যাম্পিয়ন হয়। এবং এখনও পর্যন্ত এই দুটি খেতাব ইস্টবেঙ্গলই সবচেয়ে বেশিবার জিতেছে। দেখেছে আরও অনেক সাফল্যের মুখ।
কত লড়াই, কত সংগ্ৰাম, কত ইতিহাস। ইস্টবেঙ্গল যে শুধু একটি ফুটবল দল নয়। এই ক্লাব হচ্ছে
একটা জাতির আদর্শের প্রতীক। প্রতিটি মুহূর্তে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক। শুধু তাই নয়, এই
ক্লাব সর্বহারাদের বেঁচে থাকার প্রেরণাও বটে। ১৯৪৭এ ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। দেশভাগ হয়। পূর্ববঙ্গ
হয়ে যায় পূর্ব পাকিস্তান। ঘরছাড়া হয় পূর্ববঙ্গে বসবাসকারি অগুনতি পরিবার। সব কিছু হারিয়ে
দিশাহীন হয়ে স্বাধীন ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে উদ্বাস্তু হয়ে ঠাই নিতে হয় বাঙালদের। সেই চরম দুর্দিনে
পূর্ববঙ্গের সর্বহারা মানুষদের আত্মসম্মান ও মর্যাদার প্রতীক হয়ে ওঠে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব। এই ক্লাবের
প্রতিটি জয় পরাজয় যেন সেইসমস্ত কাঁটাতার পেরিয়ে আসা সর্বহারা মানুষদের জীবনের এক একটি
অধ্যায়। সেই অসহায় মানুষেরা নিজেদের বাঁচার প্রেরণা পেত লাল হলুদের পতাকা থেকে। ইস্টবেঙ্গলের
জয় মানেই তো তাঁদের জয়, তাদের জীবনযুদ্ধে এক একটা বাধা পার করা।
'এভরিওয়ান হ্যাস দা ফায়ার, বাট দা চ্যাম্পিয়নস্ নো হোয়েন টু ইগনাইট দেম'। কথাটা বোধহয় ইস্টবেঙ্গল এবং তার সমর্থকদের কথা ভেবেই লেখা। তাই তো শতবর্ষেও মশাল অনির্বাণ। এবং চিরকাল
থাকবে।এবং পথ দেখাবে জীবনযুদ্ধের স্রোতে ভেসে থাকা অগুনতি সাধারণ মানুষকে।
যেমন ভাবা, তেমন কাজ। সুরেশ চন্দ্র চৌধুরী, রমেশ চন্দ্র সেন, অরবিন্দ ঘোষ, শৈলেশ বসু মিলে গঠন করলেন নতুন ক্লাব। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন সন্তোষের মহারাজা মন্মথনাথ রায়চৌধুরী স্বয়ং। ১লা অগস্ট, ১৯২০ তে এই নতুন ক্লাবের প্রথম আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হয়। ভবিষ্যৎ কার্যকলাপ নিয়েও আলোচনা হয়। কিন্তু ক্লাবের একটা নাম তো দিতে হবে। কি নাম দেওয়া যায় ভাবতে ভাবতে হঠাৎই শৈলেশ বসু ইস্টবেঙ্গল নামটি প্রস্তাব করেন। প্রথমে কেউ রাজি হননি। পরে অবশ্য এই নামটিই গ্ৰহণ করা হয়।
নাম তো হল। কর্মসমিতিও গঠন হল। ঠিক হল, এই ক্লাব এখন থেকে আইএফএ আয়োজিত সমস্ত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবে। কিন্তু কি রঙের জার্সি পড়ে খেলবে এই দল? বহু চিন্তা ভাবনার পরেও ঠিক করে উঠতে পারলেন না কেউ।
এর মধ্যে একদিন সুরেশ বাবু একদিন রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলেন। হাঁটতে হাঁটতে একটি দোকানের দিকে দৃষ্টি পড়ে তাঁর। দেখেন, লাল আর হলুদ রঙের একটি জার্সি টাঙানো রয়েছে। দেখা মাত্রই সুরেশ বাবু ঠিক করেন, এই জার্সিটাই চাই। সেইমতো দোকানদারকে দাম জিজ্ঞাসা করেন। কিন্তু দোকানদার বলেন যে সাহেবদের কোন ক্লাব ওই জার্সি ইতিমধ্যেই পছন্দ করে গেছেন। তাছাড়া ওই জার্সির দামও বেশি। কিন্তু কোন ওজর আপত্তিই শুনলেন না সুরেশ বাবু। শেষ পর্যন্ত বেশি দাম দিয়েই লাল হলুদ রঙের ওই জার্সি কিনে নেন তিনি। পরে ক্লাবের অন্যান্য সদস্যদের দেখালে তাঁদেরও ওই জার্সি দারুণ পছন্দ হয়।
কিছু দিন পরেই সেই জার্সি গায়ে ইস্টবেঙ্গল দলের খেলোয়াড়রা হারকিউলিস কাপ খেলতে নামেন। এবং প্রথম টুর্নামেন্টে খেলতে নেমেই চ্যাম্পিয়ন হয় ইস্টবেঙ্গল ক্লাব। এরপর দুর্দান্ত পারফরম্যান্সকে হাতিয়ার করে
কলকাতা ফুটবল লীগের দ্বিতীয় ডিভিশনে জায়গা আদায় করে নেয় তাঁরা। ১৯২৪এ অসাধারণ ফুটবল খেলে তারা কলকাতা ফুটবল লীগের দ্বিতীয় ডিভিশনের শীর্ষস্থান দখল করে ব্রিটিশ রেজিমেন্টের দল ক্যামেরন 'বি' এর সাথে যুগ্মভাবে। ক্যামেরনের অন্য একটি দল ইতিমধ্যেই প্রথম ডিভিশনে নিয়মিত খেলে। ফলে তাঁদের নতুন করে প্রথম ডিভিশনে যোগ্যতা অর্জন করার কোনো প্রয়োজন ছিল না। তাই তারা নাম প্রত্যাহার করে। স্বাভাবিক ভাবেই ইস্টবেঙ্গল যোগ্যতা অর্জন করে কলকাতা লীগের প্রথম ডিভিশনে খেলার।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, যোগ্যতা অর্জন করা স্বত্ত্বেও ইস্টবেঙ্গলকে প্রথম ডিভিশনে উত্তীর্ণ করার ক্ষেত্রে অনেকেই বিরোধিতা করেন। তখন ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের সভাপতি রাজা মন্মথনাথ রায়চৌধুরী পত্র লিখে ইস্টবেঙ্গল কে প্রথম ডিভিশন লীগে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান। পরবর্তীকালে প্রথম ডিভিশনের আটটি বিদেশী তথা ইউরোপীয় দল ইস্টবেঙ্গলকে প্রথম ডিভিশনে উত্তরণের পক্ষে মতামত দেয়। দুটি দল বিরোধিতা করে। অবাক করার মত বিষয় হল, সেই দুই দল ছিল মোহনবাগান ও এরিয়ান। শেষ পর্যন্ত গরিষ্ঠ সংখ্যক দল পক্ষে কথা বলার ফলে প্রথম ডিভিশনে উত্তীর্ণ হয় ইস্টবেঙ্গল।
এত কম সময়ে কলকাতা লীগের প্রথম ডিভিশনে উত্তরণ! তার ওপর চূড়ান্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে। কেউ বোধহয় কল্পনাও করতে পারেননি। কিন্তু এটাই ইস্টবেঙ্গল। জন্মের পর থেকে এভাবেই একের পর এক বাধার সোপান অতিক্রম করে এগিয়ে চলতে থাকে তারা। এবং শুধু এগিয়ে চলাই নয়, ক্লাবকর্তাদের অদম্য ইচ্ছাশক্তির দরুণ একের পর এক সাফল্যও আসতে শুরু করে। ২৫শে মে, ১৯২৫। আরও এক ঐতিহাসিক দিন, কলকাতা তথা ভারতীয় ফুটবলে। যে মোহনবাগান শুধু মাত্র পূর্ববঙ্গীয় দল হওয়ার কারণে ইস্টবেঙ্গলের প্রথম ডিভিশনে খেলার বিরোধিতা করে, ইতিহাসে প্রথমবার খেলার মাঠে তাদের মুখোমুখি হলো ইস্টবেঙ্গল। এবং নোংরা রাজনীতির জবাব খেলার মাঠেই দেয় ইস্টবেঙ্গল। নেপাল চক্রবর্তীর করা একমাত্র গোলে মোহনবাগানকে পরাজিত করে তারা। সেই সময় থেকেই আস্তে আস্তে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে শুরু করে ইস্টবেঙ্গল ও মোহনবাগান।
১৯৩০ খ্রীষ্টাব্দে গান্ধীজির সত্যাগ্ৰহ আন্দোলনের সময়ে সমস্ত ভারতীয় দল কলকাতা লীগ থেকে নাম তুলে নেয়।
কিন্তু এরপর যে কান্ড ঘটে, তা অভাবনীয়। আইএফএ পয়েন্ট তালিকায় প্রথম স্থানে না থাকা স্বত্ত্বেও রয়াল
রেজিমেন্টকে কলকাতা লীগের প্রথম ডিভিশনের চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করে এবং কোনো কারণ ছাড়াই
ইস্টবেঙ্গলকে দ্বিতীয় ডিভিশনে নামিয়ে দেয়। প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন লাল হলুদ সমর্থকরা। হাজার
হাজার ইস্টবেঙ্গল সমর্থক রাস্তায় নামেন হাতে জ্বলন্ত মশাল নিয়ে। শেষ পর্যন্ত চাপে পড়ে আইএফএ বাধ্য হয়
ইস্টবেঙ্গলকে প্রথম ডিভিশন লীগে উত্তীর্ণ করতে। ক্লাবের সমর্থকদের সেই লড়াইকে সম্মান জানিয়ে মশালকে ক্লাবের প্রতীক হিসাবে স্বীকৃতি দেন তৎকালীন কর্মকর্তারা।
প্রতিটি পদক্ষেপে এইভাবেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব ও তার সমর্থকরা। চাপের কাছে
কোনদিন ও মাথা নত করেননি তাঁরা। আর তাই ইস্টবেঙ্গল সম্পর্কে বলা হয়, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে তারা বাঘ হয়ে যায়। এই নাছোড় মনোভাবের প্রভাব খেলার মাঠেও পড়ত। ১৯৪২এ প্রথমবার কলকাতা লীগ জয় করে ইস্টবেঙ্গল। পরের বছর তারা প্রথমবারের জন্য আইএফএ শিল্ডে চ্যাম্পিয়ন হয়। এবং এখনও পর্যন্ত এই দুটি খেতাব ইস্টবেঙ্গলই সবচেয়ে বেশিবার জিতেছে। দেখেছে আরও অনেক সাফল্যের মুখ।
কত লড়াই, কত সংগ্ৰাম, কত ইতিহাস। ইস্টবেঙ্গল যে শুধু একটি ফুটবল দল নয়। এই ক্লাব হচ্ছে
একটা জাতির আদর্শের প্রতীক। প্রতিটি মুহূর্তে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক। শুধু তাই নয়, এই
ক্লাব সর্বহারাদের বেঁচে থাকার প্রেরণাও বটে। ১৯৪৭এ ভারত স্বাধীনতা লাভ করে। দেশভাগ হয়। পূর্ববঙ্গ
হয়ে যায় পূর্ব পাকিস্তান। ঘরছাড়া হয় পূর্ববঙ্গে বসবাসকারি অগুনতি পরিবার। সব কিছু হারিয়ে
দিশাহীন হয়ে স্বাধীন ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে উদ্বাস্তু হয়ে ঠাই নিতে হয় বাঙালদের। সেই চরম দুর্দিনে
পূর্ববঙ্গের সর্বহারা মানুষদের আত্মসম্মান ও মর্যাদার প্রতীক হয়ে ওঠে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব। এই ক্লাবের
প্রতিটি জয় পরাজয় যেন সেইসমস্ত কাঁটাতার পেরিয়ে আসা সর্বহারা মানুষদের জীবনের এক একটি
অধ্যায়। সেই অসহায় মানুষেরা নিজেদের বাঁচার প্রেরণা পেত লাল হলুদের পতাকা থেকে। ইস্টবেঙ্গলের
জয় মানেই তো তাঁদের জয়, তাদের জীবনযুদ্ধে এক একটা বাধা পার করা।
'এভরিওয়ান হ্যাস দা ফায়ার, বাট দা চ্যাম্পিয়নস্ নো হোয়েন টু ইগনাইট দেম'। কথাটা বোধহয় ইস্টবেঙ্গল এবং তার সমর্থকদের কথা ভেবেই লেখা। তাই তো শতবর্ষেও মশাল অনির্বাণ। এবং চিরকাল
থাকবে।এবং পথ দেখাবে জীবনযুদ্ধের স্রোতে ভেসে থাকা অগুনতি সাধারণ মানুষকে।
No comments:
Post a Comment