ফিরে দেখা। - দীপ্তাশিস দাশগুপ্ত - Sports Gallery

Sports Gallery

খেলাধুলার সব খবর, একসাথে হাতের মুঠোয়

ফিরে দেখা। - দীপ্তাশিস দাশগুপ্ত

Share This
ভারতীয় ফুটবলকে ইস্টবেঙ্গল ক্লাব অনেক গৌরব জনক মুহূর্ত উপহার দিয়েছে। যার মধ্যে অন্যতম হল  ২০০৩ খ্রীষ্টাব্দে আসিয়ান কাপ জয়। ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে যা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক ঘটনা। কারণ এর আগে ভারতের কোন ক্লাব দল উপমহাদেশের বাইরে গিয়ে কোন ট্রফি জিতে আসতে পারেনি। তার আগে বিদেশের মাটিতে ভারতের কোনো ক্লাব ফুটবল দলের ট্রফিজয় বলতে ছিল কেবলমাত্র ১৯৯৩ খ্রীষ্টাব্দে নেপালে ওয়াই ওয়াই কাপ জয়। সেই সাফল্যও আসে ইস্টবেঙ্গলের হাত ধরেই।

এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো যে আসিয়ান কাপ সংগঠন করা হয় আসিয়ান সদস্যভুক্ত দেশগুলোর দ্বারা। স্বাভাবিক ভাবেই তাই এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে থাকে কেবলমাত্র আসিয়ান সদস্যভুক্ত দেশের ক্লাবদলগুলো। উল্লেখযোগ্য ব‍্যাপার হল, ভারত আসিয়ান সদস্যভুক্ত দেশ নয়। কিন্তু ২০০২-০৩ মরসুমে ভারতের ঘরোয়া ফুটবলে অসাধারণ সাফল্যের কারণে ইস্টবেঙ্গলকে আমন্ত্রণ জানানো হয় আসিয়ান কাপের আয়োজক কমিটির তরফ থেকে। সেই মরসুমে মশালবাহিনী পাঁচটি ট্রফিতে খেলে পাঁচটিতেই চ‍্যাম্পিয়ন হয়‌ যার মধ্যে ছিল কলকাতা সুপার ডিভিশন লীগ, নওগা ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপ, আইএফএ শিল্ড, ডুরান্ড কাপ এবং জাতীয় ফুটবল লীগ।

আসিয়ান কাপে সেইবছর অংশ নিয়েছিল মোট বারোটি দল। যার মধ্যে মায়ানমারের ফিনান্স অ্যন্ড রেভিনিউ এফসি শুরুতেই দল তুলে নেয় একটি ম‍্যাচও না খেলে। ইস্টবেঙ্গলের গ্ৰুপে পড়েছিল ২০০১-০২ মরসুমে থাই লীগের চ‍্যাম্পিয়ন ও ২০০২ তে এএফসি চ্যাম্পিয়নস্ লীগের রানার্স আপ দল বেক তেরো সাসানা এবং ২০০২ তে ফিলিপাইন লীগজয়ী ফিলিপাইন্স আর্মি। উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, থাইল্যান্ডের বেক তেরো সাসানা ছিল কাগজে কলমে টুর্নামেন্টের সবচেয়ে শক্তিশালী দল। এবং বেক তেরো সাসানার চাইম‍্যান তখন এশিয়ার অন‍্যতম শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়।

আসিয়ান কাপের শুরুটা অবশ্য ভালো হয়নি লাল হলুদের। গ্ৰুপ ডি র প্রথম ম‍্যাচে তুল‍্যমুল‍্য লড়াইয়ের পর খেলার পঁচাশি মিনিটে চাইম‍্যানের করা একমাত্র গোলে বেক তেরো সাসানার বিরুদ্ধে ০-১ গোলে পরাজিত হয় তারা। যদিও সেই খেলায় রেফারির পক্ষপাতিত্বের শিকার হয় ইস্টবেঙ্গল। মালসাওয়ামটুলুঙ্গাকে পেনাল্টি বক্সের ভিতরে অবৈধভাবে বাধা দেওয়া স্বত্ত্বেও লাল হলুদকে পেনাল্টি দেননি রেফারি। কিন্তু পরের ম‍্যাচে আর রোখা যায়নি ইস্টবেঙ্গলকে। ফিলিপাইনস্ আর্মিকে ৬-০ গোলে কার্যত উড়িয়ে দেয় লাল হলুদ ব্রিগেড। ছয়টি গোলই করেন বাইচুং। ক্লাব ফুটবলের আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সেটাই ছিল কোন ভারতীয় ফুটবলারের প্রথম ডাবল হ‍্যাটট্রিক। এই বিশাল ব‍্যবধানে জয়ের দরুন সহজেই কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে লাল হলুদ ব্রিগেড। কোয়ার্টার ফাইনালে তারা মুখোমুখি হয় পারসিতা টাঙ্গেরাঙের। যারা কিনা ২০০২তে লিগা ইন্দোনেশিয়ার রানার্স আপ দল। টুর্নামেন্টে গ্ৰুপ সির শীর্ষস্থান দখল করেছে। সবচেয়ে বড় কথা, ঘরের মাঠে খেলছে তারা। কিন্তু খেলার শুরু থেকেই সমানে সমানে লড়তে থাকে ইস্টবেঙ্গল। বিরতির একটু পরে দুর্দান্ত হেডে গোল করে ইস্টবেঙ্গলকে এগিয়ে দেন বাইচুং। কিন্তু এরপর আবার পক্ষপাতদুষ্ট রেফারিংয়ের শিকার হয় লাল হলুদ। পারসিতার জয়কেসুমার পা থেকে একের বিরুদ্ধে এক পরিস্থিতিতে অসাধারণ সেভ করেন লাল হলুদের গোলরক্ষক সন্দীপ নন্দী। কিন্তু কোথায় কি! রেফারি উল্টে সন্দীপকেই হলুদ কার্ড দেখিয়ে পারসিতাকে পেনাল্টি উপহার দেন। যা থেকে গোল করে পারসিতাকে সমতায় ফেরান জয়কেসুমা নিজেই। কিন্তু লড়াই যাদের রক্তে, তাদের কি দমিয়ে রাখা যায়! মালসাওয়ামটুলুঙ্গার মাপা ক্রস থেকে অসাধারণ হেড থেকে গোল করে লাল হলুদকে পুনরায় এগিয়ে দেন বিজেন সিংহ। শেষ পর্যন্ত ২-১ গোলে জিতে সেমিফাইনালে ওঠে ইস্টবেঙ্গল।

সেমিফাইনালে ইস্টবেঙ্গল মুখোমুখি হল পেট্রোকেমিয়া পুট্রার। যারা কিনা ২০০২ এ লিগা ইন্দোনেশিয়ার চ‍্যাম্পিয়ন দল। প্রচণ্ড শক্তিশালী দল। তার ওপর ঘরের মাঠে খেলা হওয়াতে দর্শক সমর্থনও তাদের পক্ষে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হল রেফারিং। তখনও পর্যন্ত প্রতিটি খেলাতেই রেফারির কোন না কোনো সিদ্ধান্ত লাল হলুদের বিরুদ্ধে গিয়েছে। সেমিফাইনালেও তার ব‍্যতিক্রম হল না। খেলা তেইশ মিনিট অতিক্রান্ত হয়েছে। বক্সের বাইরে ফ্রিকিক পেয়েছে পেট্রোকেমিয়া। ইস্টবেঙ্গল গোলরক্ষক সন্দীপ নন্দী তখন ওয়াল সাজাচ্ছেন। কিন্তু চূড়ান্ত অখেলোয়াড়োচিত আচরণ প্রদর্শন করে সন্দীপ নন্দীকে তৈরি হবার সুযোগ না দিয়েই জয়নাল ইচওয়ান গোল লক্ষ্য করে শট নেন এবং বল জালে চলে যায়। এবং রেফারিও সেটিকে গোল বলে ঘোষণা করেন। পিছিয়ে যায় লাল হলুদ। বিদেশের মাঠে প্রতিকূল পরিস্থিতি। তার ওপর প্রতি পদক্ষেপে রেফারির বিমাতাসুলভ আচরণ। অন্য কোনো দল হলে হয়তো ওখানেই হাল ছেড়ে দিত। কিন্তু না! দলটার নাম যে ইস্টবেঙ্গল। হারার আগে যে তারা  হার স্বীকার করে না। বিরতিতে গোটা দলকে উদ্বুদ্ধ করেন দলের অধিনায়ক সুলেমুসা, কোচ সুভাষ ভৌমিক ও বাইচুং। দ্বিতীয়ার্ধে প্রবলভাবে ম‍্যাচে ফিরে আসে ইস্টবেঙ্গল। দুরন্ত গোল করে লাল হলুদকে সমতায় ফেরালেন সেই বাইচুং। এর পরে যখন ক্রমশ খেলার ওপর প্রাধান্য বিস্তার করতে আরম্ভ করছে, তখন পুনরায় সক্রিয় হন রেফারি। নিতান্তই সামান্য অপরাধ। আর তাতেই সরাসরি লাল কার্ড! মাঠের বাইরে চলে গেলেন লাল হলুদের অন‍্যতম নির্ভরযোগ্য স্টপার মহেশ গাউলি। দশজনের লাল হলুদ ব্রিগেড এরপর দাঁতে দাঁত চিপে লড়াই চালায় প্রবল শক্তিধর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। শেষ পর্যন্ত সাডেন ডেথে পেট্রোকেমিয়াকে ৭-৬ গোলে পরাজিত করে ফাইনালে ওঠে ইস্টবেঙ্গল। রচিত হয় নতুন ইতিহাস।

অবশেষে এল সেই ঐতিহাসিক ফাইনাল। প্রথম ভারতীয় ক্লাব দল হিসাবে এশিয়ার কোনো টায়ার ওয়ান টুর্নামেন্টের ফাইনালে খেলবে ইস্টবেঙ্গল। প্রতিপক্ষ সেই বেক তেরো সাসানা। যাদের কাছে প্রথম ম‍্যাচেই হারতে হয়েছিল কিছুটা রেফারির বদান্যতায়। ততদিনে অবশ্য ইস্টবেঙ্গল এবং ভারতীয় ফুটবল সম্পর্কে সকলের ধারণা বদলে গিয়েছে। রীতিমতো সমীহ করছে তখন সকলে লাল হলুদকে। মাঠে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স তো বটেই, তাছাড়াও সবচেয়ে আকর্ষক বিষয় হল দলের হার না মানা মনোভাব। এবং ফাইনালে এই মনোভাবকে হাতিয়ার করেই এএফসি চ‍্যাম্পিয়নস্ লীগে রানার্স হওয়া বেক তেরো সাসানাকে শুরু থেকেই কোনঠাসা করে দেয় ইস্টবেঙ্গল। তাদের প্রধান খেলোয়াড় চাইম‍্যানকে কার্যত বোতলবন্দি করে রাখেন ষষ্ঠী দুলে। কুড়ি মিনিটের মাথায় আলভিটোর দুর্দান্ত থ্রু বল থেকে জোরালো শটে গোল করে ইস্টবেঙ্গলকে ১-০ এগিয়ে দেন মাইক ওকোরো। এরপর দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতেই আবার গোল। এবার বাইচুং। গোল করাটা যেন তার কাছে জলভাত। পেনাল্টি বক্সে বল ধরে শরীরের দোলায় গোলরক্ষককে বোকা বানিয়ে অনায়াসে টুর্নামেন্টে নিজের নবম গোলটি করে ফেলেন তিনি। এরপর অবশ্য সাময়িকভাবে খেলায় ফিরে আসে বেক তেরো সাসানা। একটি গোলও শোধ করে তারা। কিন্তু উনসত্তর মিনিটে বক্সের বাইরে থেকে ডান পায়ের জমিঘেষা শটে অনবদ্য গোল করে ইস্টবেঙ্গলকে ৩-১ এ এগিয়ে দেন আলভিটো ডি'কুনহা। এরপর আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি বেক তেরো সাসানা। ট্রফি তো ইস্টবেঙ্গল জেতেই, সেইসঙ্গে মাত্র পাঁচটি খেলায় নয় গোল করে সেরা ফরওয়ার্ডের পুরষ্কার পান বাইচুং। সন্দীপ নন্দী হন সেরা গোলরক্ষক।

বিদেশি দলের বিরুদ্ধে ইস্টবেঙ্গলের রেকর্ড বরাবর ই খুব ভালো। আসিয়ান কাপ জয় যেন সেই রেকর্ড কেই আরও সমৃদ্ধ করলো। পাশাপাশি সমগ্ৰ ফুটবল দুনিয়ার কাছে ভারতীয় ফুটবলের যেন নতুন করে পরিচয় লাভ করল। 

No comments:

Post a Comment

Pages