বিশ্বকাপ ফুটবলঃ তারকা পরিচয় - পেলে | কলমে দীপ্তাশিস দাসগুপ্ত - Sports Gallery

Sports Gallery

খেলাধুলার সব খবর, একসাথে হাতের মুঠোয়

বিশ্বকাপ ফুটবলঃ তারকা পরিচয় - পেলে | কলমে দীপ্তাশিস দাসগুপ্ত

Share This
ফুটবল কে বলা হয় 'The Beautiful Game'। অর্থাৎ সুন্দর খেলা। সেই সুন্দর খেলাটিকে কিছু কিছু মানুষের জন্য আরও সুন্দর লাগে। সেইসমস্ত অসাধারণ প্রতিভাবান খেলোয়াড়, যারা তাঁদের অসাধারণ নৈপুণ্য দিয়ে সারা বিশ্বকে মাতিয়েছেন। বিশ্বকাপের মত প্রতিযোগিতা যাদের পায়ের যাদুতে সমৃদ্ধ হয়েছে। এমনই একজনের কথা বলব আজ। যিনি কিনা অসীম দারিদ্র ও বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ফুটবলার হয়েছিলেন। তাঁর ভালো নাম Edson Arantes do Nascimento। এই নামটিতে তাঁকে যত না চেনা যায়, তাঁর থেকেও বেশী চেনা যায় তাঁকে তাঁর ডাকনামে। তাঁর ডাকনাম হল পেলে। অথবা ফুটবল সম্রাট পেলে। যাকে এখন অবধি বিশ্বের সর্বকালের সেরা ফুটবলার হিসেবে মানা হয়। 



তাঁর অসাধারণ সব পায়ের কাজ, অসাধারণ সব গোল আজ ও সারা বিশ্ব জুড়ে বহু ফুটবল প্রেমীর হৃদয়ের মণি কোঠায় সযত্নে সাজানো রয়েছে। যখন খেলতেন, বলতে গেলে সম্মোহিত করে রাখতেন দর্শক দের। তাঁর সময় থেকেই ব্রাজিলের খেলার সাথে 'জোগো বনিতো' কথাটি সমার্থক হয়ে গেছে। যেন গোটা ফুটবল প্রাঙ্গণটি একটি সবুজ ক্যানভাস, আর সেই ক্যানভাসে যেন তুলি দিয়ে কেউ আপন মনে আঁকি বুকি কাটছে। এমন ই সাবলীল ছিল তাঁর খেলার ভঙ্গি।যিনি তাঁর দেশ ব্রাজিলের হয়ে ১৯৫৮, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৭০ এই ৪ টি বিশ্বকাপে অংশ নিয়ে তাঁর মধ্যে ৩ টি তেই (১৯৫৮, ১৯৬২ ও ১৯৭০)ব্রাজিল কে চ্যাম্পিয়ন করে চিরকালের জন্য জুলে রিমে ট্রফি প্রাপ্ত করান সেই পেলের জন্ম ১৯৪০ সালের ২৩ শে অক্টোবর ব্রাজিলের Três Corações এ। তাঁর বাবা ও ছিলেন ফুটবলার। নাম João Ramos, পরিচিত ছিলেন Dondinho নামে। জন্মের পর থেকেই তাঁকে নানান সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছে ঘরে ও বাইরে। তাঁর ভালো নাম Edson রাখা হয়েছিল Thomas Edison এর নামে, কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রে Birth Certificate এ নামের বানান নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। সেইসময় তাঁর প্রিয় খেলোয়াড় Bile র নামের অনুকরণে তাঁর সমবয়েসিরা তাঁকে পেলে বলে ডাকতে আরম্ভ করেন একরকম উত্যক্ত করেই। ক্রমশ এই নামটি ছড়িয়ে পরে। 



তাঁর পরিবারে এতটাই দারিদ্র ছিল যে শৈশবে একটা সময় তাঁকে একটি চায়ের দোকানে চাকরের কাজ করতে হয় অর্থ উপার্জনের জন্য। কিন্তু ফুটবলের প্রতি টান ছিল ছোট বেলা থেকেই। দারিদ্র এখানেও তাঁর সামনে দেওয়াল হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর বাবা নিজে ফুটবলার হলেও সেইসময় তাঁর পরিবারের আর্থিক অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে ফুটবলের সামগ্রী তো দূরে থাক, একটা ভালো ফুটবল পর্যন্ত কিনে দেবার সামর্থ্য তাঁর ছিল না। কোনরকমে ফেলে দেওয়া কাগজ বা ছেঁড়া মোজা দলা পাকিয়ে তাই দিয়েই রাস্তায় রাস্তায় খালি পায়ে খেলতেন তিনি। এছাড়াও মাঝে মাঝে Indoor ফুটবল ও খেলতেন তিনি Radium নামক একটি ক্লাবের হয়ে। এরই মাঝে বিভিন্ন অপেশাদার দলের হয়ে যুব ফুটবলে বেশ কয়েকটি ট্রফি জেতেন। Bauru Athletic Club কে দুটি জুনিয়র রাজ্য চ্যাম্পিয়নশিপ জেতানোর পর প্রথম শিরোনামে আসেন তিনি।কিন্তু তবুও কোনও এক অজানা কারণে সেইসময়ে ব্রাজিলের সমস্ত নামকরা পেশাদার দল তাঁকে বাতিল করে দিচ্ছিল। শেষমেষ তিনি সুযোগ পান Santos FC তে, যে ক্লাবের হয়ে তিনি ১১২০ টি খেলাতে ১০৩৩ টি গোল করেছেন ও পরে NY Cosmos এর হয়ে ১০৭ টি খেলাতে ৬৪ টি গোল করেছেন। 



শুধু নিজে দুর্দান্ত খেলাই নয়, বিভিন্ন সময়ে জিতেছেন বিভিন্ন ট্রফি এই দুই ক্লাবের হয়ে। Santos FC র হয়ে ১০ বার Campeonato Paulista, ৪ বার Torneio Rio-São Paulo, ৬ বার Campeonato Brasileiro Série A, ২ বার Copa Libertadores এবং ২ বার Intercontinental Cup জিতেছেন ও তার পর NY Cosmos এর হয়ে ৩ বছরে ৪ টি ট্রফি জিতেছেন। কিন্তু এটা শুধু ক্লাবের হয়ে। এছাড়াও ব্রাজিলের জাতীয় দলের জার্সি গায়ে তিনি অনন্য সমস্ত নজির গড়েছেন। সুন্দর ফুটবল খেলে একের পর এক ম্যাচ তথা tournament ই নয়, জিতেছেন আপামর ফুটবল প্রেমী মানুষের হৃদয় ও। মোট খেলেছেন ১১৪ টি ম্যাচ, এবং গোল করেছেন ৯৫ টি। একটি উল্লেখ যোগ্য তথ্য হচ্ছে পেলে এবং Garrincha এই দুজনে যেই খেলাতে ব্রাজিলের হয়ে গোল করেছেন সেই খেলাতে ব্রাজিল কখনো পরাজিত হয়নি। বিশেষত বিশ্বকাপে পেলের খেলা তো গোটা পৃথিবী তে একটা মিথ হয়ে গেছে। ১৯৫৮ বিশ্বকাপে যখন ব্রাজিলের জার্সি গায়ে মাঠে নামেন, তখন তার বয়স মাত্র ১৭। কিন্তু সেই বয়েসেই তাঁর খেলা তাবড় তাবড় প্রতিপক্ষের রাতের ঘুম উড়িয়ে দিয়েছিল। দাপিয়ে খেলেছিলেন গোটা বিশ্বকাপ। ফাইনালে সুইডেন কে প্রায় একার হাতে গুঁড়িয়ে দেন। করেন দুটি গোল। ব্রাজিলকে জেতান প্রথম বিশ্বকাপ। 



এরপর ১৯৬২ বিশ্বকাপ। সেখানে দ্বিতীয় খেলার পর পেলে আহত হয়ে আর খেলতে না পারলেও Garrincha, Didi, Vava, Amerildo দের কারণে বিশ্বকাপ জিততে অসুবিধে হয়নি। ১৯৬৬ তে বলা চলে তাঁকে একরকম মারধর করে স্বাভাবিক খেলা খেলতে দেয়নি বিপক্ষের খেলোয়াড়রা। কিন্তু ১৯৭০ এ আবার স্বমহিমাতে জ্বলে ওঠেন পেলে। তাঁর শেষ বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন করিয়ে চিরদিনের মত জুলে রিমে ট্রফি প্রাপ্ত করান ব্রাজিল কে। বিশ্বকাপ এ ব্রাজিলের হয়ে মোট ১৬ টি খেলাতে ১২ টি গোল করেন। ব্রাজিল কে শুধু তিনবার বিশ্বকাপ ই নয়, ২ বার Roca Cup, ৩ বার Cruz Cup ও ১ বার করে Bernardo O'Higgins Cup ও Atlantic Cup ও জেতান। এছাড়া ১৯৫৯ এ Copa America তে ৮ টি গোল করে সর্বোচ্চ গোল দাতা হন। মূলত ফরওয়ার্ড হলেও মাঝমাঠের ও বিভিন্ন জায়গাতে খেলতে পারতেন। তাঁর ব্যাক্তিগত নৈপুণ্যের কারণে বিপক্ষের খেলোয়াড়রা সবাই দিশেহারা হয়ে পরতেন। বহু বার নিজের ব্যাক্তিগত দক্ষতায় ৪ থেকে ৫ জন খেলোয়াড় কেও কাটিয়ে গোল করেছেন। এমন কোনও ব্যাক্তিগত খেতাব নেই যেটা তিনি জেতেন নি। বিশেষত Ballon D’or খেতাব জিতেছেন ৭ বার, যা সকলের চেয়ে বেশী। 



এছাড়াও জিতেছেন FIFA Order of Merit, FIFA Centennial Award, Greatest football player to have ever played the game, by Golden Foot, FIFA Ballon d'Or Prix d'Honneur এর মত পুরষ্কার। তবে সবচেয়ে বড় পুরষ্কার বোধহয় FIFA Player of the Century যা তিনি পান ২০০০ সালে, যা তাঁকে করে তোলে সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবল খেলোয়াড়। সত্যি, তাঁর সম্পর্কে যত বলা হয় ততই যেন কম হয়। শুধু খেলা নয়, বহু সমাজ কল্যাণ মুলক কাজেও তিনি যুক্ত।১৯৯৪ সালে তিনি UNESCO Goodwill Ambassador হিসেবে নিযুক্ত হন।এছাড়া ও তিনি অভিনয় ও করেছেন। অভিনয় করেছেন বহু চলচ্চিত্রে যার মধ্যে অন্যতম হল 'Escape to Victory'। 



Cristiano Ronaldo তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, "Pelé is the greatest player in football history, and there will only be one Pelé" । José Mourinho বলেছেন, "I think he is football. You have the real special one – Mr. Pelé." Alfredo Di Stéfano বলেছেন, "The best player ever? Pelé. Lionel Messi and Cristiano Ronaldo are both great players with specific qualities, but Pelé was better"। Nelson Mandela র মতন ব্যাক্তিত্ব তাঁকে Lifetime Achievement Award দিতে গিয়ে বলেন,"To watch him play was to watch the delight of a child combined with the extraordinary grace of a man in full." 1



999 তে International Federation of Football History & Statistics (IFFHS) Pelé কে World Player of the Century সম্মানে ভূষিত করে এবং International Olympic Committee তাঁকে Athlete of the Century সম্মান দেয়। ১৯৭৭ সালে ভারতে এসে কলকাতাতে একটি প্রীতি ম্যাচ খেলেন মোহন বাগানের সাথে, যা দেখতে ৮০০০০ লোক হয়েছিল। ফুটবলের আকাশে সবচেয়ে উজ্জলতম নক্ষত্র হিসেবে তিনি বিরাজ করছেন ও করবেন।

No comments:

Post a Comment

Pages