কর্পোরেট । জয়জিৎ সিংহ রায় - Sports Gallery

Sports Gallery

খেলাধুলার সব খবর, একসাথে হাতের মুঠোয়

কর্পোরেট । জয়জিৎ সিংহ রায়

Share This




আমেরিকান এয়ারলাইন্সের বিমানের চাকা কলকাতার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাটি ছুঁতেই সুজয় বোসের অশ্রুসজল চোখের কোনদুটো চিকঁচিঁক করে উঠল । পঁচিশ বছর পর কলকাতায় পা রাখলো বাগবাজারের আবির ওরফে মার্কিন মুলুকের অন্যতম সেরা ভারতীয় ব্যবসায়ী সুজয় বোস । ২০১৮র পর ২০৪৩ । এই পঁচিশ বছরে অনেক কিছুই যে পাল্টে গেছে, সেটা বিমানবন্দর থেকে বেড়িয়ে ট্যাক্সি ধরতেই বেমালুম উপলব্ধি করতে পারলো সুজয় । এই পঁচিশ বছরে কলকাতা শহরটা অনেক ঝাঁ চকচকে হয়ে গেছে তার নিজের জীবনের মতোই । অনেক কিছুই পাল্টে গেছে তার জীবনে । শুধু পাল্টায়নি তার পুরনো কিছু পিছুটান । আর সেই পিছুটানের জেরেই সে ট্যাক্সিওয়ালাকে বললো কলকাতা ময়দানের দিকে নিয়ে যেতে । এসপ্ল্যানেড থেকে গাড়িটা ইডেন গার্ডেন্সের দিকে এগিয়ে যেতেই উত্তেজনায় জানালার কাঁচ দিয়ে মুখ বার করলো সুজয় ।

সামনে তার সেই চেনা ময়দান, সেই পুরনো বটগাছ যার ছায়ার তলে খেলা দেখার পরে বন্ধুদের সাথে চলতো লেঁবু জল, সিগারেটে টান আর আড্ডা । পুরনো স্মৃতির দোলাচলে একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলো সুজয় । সম্বিৎ ফিরতেই তড়িঘড়ি করে ট্যাক্সিওয়ালাকে বললো “ বাঁয়ে রাস্তে মে ঘুমাইয়ে ” । ততক্ষনে ট্যাক্সি ইডেনের উল্টোদিকে দুই পাশে সার দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুজয়ের কলেজ জীবনের সেই চেনা রাস্তাটায় ঢুকে পড়েছে । ট্যাক্সির সামনের কাঁচ দিয়ে দূরের দৃশ্য চোখে পড়তেই কেমন যেন একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল সুজয় । অনেক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা লাল হলুদ প্রাসাদ ক্রমশ এগিয়ে আসছিল তার দৃষ্টিতে যার সঙ্গে তার চেনা ছবির কোনো মিল খুঁজে পাচ্ছিল না সুজয় । প্রাসাদের কাছে আসতেই ট্যাক্সিটাকে দাঁড় করিয়ে সুজয় বোস বাড়িটার গেটের দিকে হাঁটা লাগালো । কিন্তু আপ্রান চেষ্টা করেও সেই রিমোট কন্ট্রোল গেটটাকে খু্ঁজে পেল না । তার সামনে একটা বিশাল দূর্গের মতন লাল হলুদ রঙের লোহার দরজা । তার পাশে একটা ছোট্ট টিকিট কাউন্টার । সেখানে লেখা আছে এশিয়া তথা ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্লাব পরিদর্শন করতে হলে মাথাপিছু দুশো টাকা লাগবে । থতমত খেয়ে সুজয় কাউন্টারের ভেতরে বসে থাকা লোকটিকে জিগ্গেস করলো “ এই টিকিট সিস্টেম কবে থেকে চালু হয়েছে দাদা ? ” । ভেতর থেকে জবাব এলো “ আপনি লাস্ট কবে এসেছিলেন ” । লাজুকভাবে মৃদু স্বরে সুজয় জবাব দিলো “ ২০১৮ সালে ” ।

কাউন্টারেের লোকটি অবাক হয়ে তাকিয়ে জিগ্গেস করলো “ এখানে থাকা হয় না বুঝি ?” । অল্প ঘাড় নেড়ে সুজয় একটা দুশো টাকার নোট বাড়িয়ে টিকিট চাইলো । কাউন্টারের ভেতর থেকে জবাব এলো “ কার্ডের দাম দুশো টাকা । ভেতরে রেস্টুরেন্টে কিছু খেতে চাইলে বা মিউজিয়াম দেখতে চাইলে কার্ড প্রয়োজন মতন রিফিল করিয়ে নেবেন ” । সুজয়ের ততক্ষনে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেছে । ট্যাক্সিওয়ালাকে একটু অপেক্ষা করতে বলে সুজয় বোস গেটের সামনে কার্ডটা সোয়াইপ করাতেই চিঁচিং ফাঁকের মতন বিশাল রাজপুতদের দূর্গের মতন দরজাটা খুলে গেল । ভেতরে প্রবেশ করতেই সুজয় বোসের চোখের মনিদুটো বিস্ময়ে স্থির হয়ে গেছে । বাঁ দিকে একটা তিনতলা বাংলোর মতন বাড়ি । সামনে সবুজ লনের মাঝে সুইমিং পুল এবং তার চারিপাশে বসার জায়গা । সুইমিং পুলের উল্টোদিকে কফিশপটা নেই । তার জায়গায় কেএফসি, ম্যাকডোনাল্ডস এবং ব্যারিস্তার কফিশপ । অনেক কষ্ট করেও যে জানালাটা দিয়ে সুজয় জার্সি কিনতো বা ইস্টবেঙ্গল সমাচার কিনতো, সেই জানালাটার হদিশ পেলো না । গ্যালারির তলায় জিমটা নেই । সেই জায়গায় একটা বিশাল কাঁচের মিউজিয়াম । সেই মিউজিয়ামে ঢুকতে গেলে তিনশো টাকা দিয়ে এন্ট্রি কার্ডটা রিফিল করাতে হবে । আগ্রহবশত এবং উত্তেজনায় কার্ড রিফিল করিয়ে মিউজিয়ামে ঢুকতেই মুগ্ধতার আবেশে নিজেকে হারিয়ে ফেললো সুজয় । ভেতরে স্যুট টাই পরিহিত অফিশিয়ালরা সোফায় বসে আছে । কাঁচের বিভিন্ন ঘরে প্রবাদপ্রতিম খেলোয়ারদের মোমের মূর্তি এবং ছবি । এছাড়া একটা আলাদা ট্রফি ঘর যেখানে দশটি আইএসএল সহ তিনবারের এএফসি কাপ সযত্নে সাজানো । একটু এগিয়ে যেতেই সুজয়ের চোখে পড়লো একটা মার্চেন্ডাইজ শপ যেখানে লাল হলুদ টি শার্ট থেকে শুরু করে বিভিন্নরকমের মার্চেন্ডাইজ সযত্নে সাজানো রয়েছে । দোকানের কাছে এগিয়ে যেতেই হঠাৎ একটি কোঁকড়া চুলের গাঁট্টাগোঁট্টা লোক জিগ্গেস করে উঠলো “ আরে সুজয়দা না ? আমাকে চিনতে পারছো ” ?

বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই সুজয় আবিষ্কার করলো তার হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর অন্যতম চেনামুখ শিবম দাসকে । আবার পঁচিশবছর পর আলিঙ্গনাবদ্ধ দুজনে । শিবমের কাছেই জানত পারলো যে গেট দিয়েই ঢুকতেই যে পুরনো অফিসঘরের কাছে বাংলোটা চোখে পড়েছিল, সেটা আসলে ফুটবলারদের থাকার জায়গা । যে কোনো এ্যাওয়ে ম্যাচে টিম খেলতে এলে ওখানেই তাদের আশ্রয় হয় । ভেতরে জিম থেকে শুরু করে জাকুজি, সবই রয়েছে । তড়িঘড়ি করে ২০০০ টাকা দিয়ে একটা জার্সি কিনে শিবমের সাথে মাঠে প্রবেশ করলো । মাঠ দেখে ততক্ষনে বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না সুজয়ের । আসল মাঠটা ছাড়াও ভেতরে দুটো ছোটো মাঠ যেখানে বাচ্চাদের বা জুনিয়রদের প্র্যাকটিস করানো হয় । গোটা গ্যালারি লালহলুদ গদিওয়ালা চেয়ারে মোড়া । সবুজঘাসের মখমলের মতন মাঠ । অবাক হয়ে সুজয় জিগ্গেস করলো যে “ এখোনো গ্যালারিতে আড্ডা বসে ? ” এতোক্ষন হাসতে থাকা শিবম একটু গম্ভীর হয়ে বললো “না গো, খেলা ছাড়া এখন মাঠে প্রবেশ নিষেধ ” । সেই মুহূর্তে পঁচিশ বছর আগের স্মৃতিগুলো সুজয়ের চোখে ভাসছিল । পলাশ, সমর, সুমন, সম্রাট, মৈনাক, জহর সব কেমন আছে, কোথায় আছে কে জানে । ওদের কথা জিগ্গেস করতেই শিবম বললো “ পুরোনোদের অনেকেই এখন আর আসে না । এখন বেশিরভাগ কলেজে পরা তরুন তরুনীদের বা নতুন প্রজন্মের চাকুরীরতদের ভীড় হয় মাঠে । সুমন সেন তার বৌ এবং তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে এখনো মাঠে আসে । কালিঘাটের সুমনের এখন কলকাতায় বিশাল শাড়ির দোকান । দোকানের নাম ইস্টবেঙ্গল বস্ত্রালয় ” ।

ততক্ষনে সুজয় বোস স্মৃতির স্মরনী বেয়ে এগোতে আরম্ভ করেছে । পূজোর সময় সুমনদের বাড়িতে জমিয়ে আড্ডা, ফ্যান্স ক্লাবের পিকনিক, ক্লাবের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ, গ্যালারিতে জমিয়ে আড্ডা এবং এরকম আরো কত সোনালি দিনের স্মৃতি । ভাবতে ভাবতে আনমোনা হয়ে পড়েছিলো সুজয় । হঠাৎ শিবমের গলার আওয়াজে হুঁশ ফিরলো সুজয়ের । “ তোমার ট্যাক্সিওয়ালা তোমার জন্য বাইরে অপেক্ষা করছে ” । এই কথা শুনেই শিবমকে বিদায় জানিয়ে সুজয় বোস তড়িঘড়ি গেটের বাইরে পা রাখলো । তার আগে সে আরেকবার পিছনপানে চেয়ে দেখে নিল তার ছেঁড়াপাতায় আঁকা হারিয়ে যাওয়া ছবিগুলো আজ কিভাবে ফ্রেমে বাঁধিয়ে আরো ঝাঁ চকচকে করে তোলা হয়েছে । বাইরে বেরোতেই সুজয়ের মনটা আনচান করে উঠলো । আবার কবে সে তার পুরনো আশ্রয়ে পা রাখতে পারবে সে নিজেও জানে না । পারিবারিক অনুষ্ঠান উপলক্ষে তড়িঘড়ি করে ঝটিকা সফরে কলকাতায় আসা । সে নিজেও জানতো না যে পঁচিশ বছর পর কলকাতা তাকে এতো বড় বিস্ময় উপহার দেবে । ট্যাক্সিতে যেতে যেতে সুজয় ভাবতে লাগলো যে এও কি সম্ভব ? এতোটাও কি পাল্টে যেতে পারে কোনোকিছু ? পরমুহূর্তেই তার মনে পড়লো তার নিজের কষ্টের দিনগুলোর কথা । জীবনযুদ্ধের সেই দিনগুলোতে ক্যাটারার আবির তখন সোদপুর স্টেশনের কাছে তার সদ্য জন্ম দেওয়া ছোটখাটো রেস্তোঁরাটাকে প্রানদান করতে ব্যস্ত । একই সঙ্গে তাকে ব্যস্ত থাকতে হতো তার নিজের হাতে জন্ম দেওয়া ফুটবল ফ্যান্সক্লাবগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যেতে ।

সেদিনের ক্যাটারার আবির আজ মার্কিন মুলুকের বিজনেস ম্যাগনেট সুজয় বোসে পরিনত । লস এ্যানজেলেস, ফ্লোরিডা, নিউইয়র্ক, মায়ামি, সিনসিনাটায় অবস্থিত তার নিজের হাতে গড়া ফুড চেনগুলো আজ মার্কিন মুলুকের বিখ্যাত সুজি’স ফুড চেন হিসেবে পরিচিত । বাগবাজারের আবিরের সঙ্গে আজকের সুজয় বোসের যে কোনো মিল নেই । তার চেনা আবির আজ বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয়দের কাছে সুজয় বা সুজি হিসেবে অনেক বেশি পরিচিত । আবির বোস তো অনেকদিন আগেই হারিয়ে গেছে । ঠিক সেরকমই বদলে গেছে তার এতোদিনের চেনা লাল হলুদ জগৎটা । আসলে পুরোনোকে পিছনে ফেলে নতুনের পথে এগিয়ে চলাকেই বোধহয় আধুনিকিকরন বলে, যার ব্যবসায়ী ছদ্মনাম কর্পোরেট । আর কর্পোরেটাইজেশনের টানে অনেক সোনালী স্মৃতি বা ভাললাগার মুহূর্তগুলো কবরের তলায় চলে যায় । পড়ে থাকে শুধু স্মৃতির মনিকোঠায় হারিয়ে যাওয়া সেই বৃষ্টিভেজা দিনগুলো ।

No comments:

Post a Comment

Pages