তারকা পরিচয় | গ্যারিঞ্চা - দীপ্তাশিস দাসগুপ্ত - Sports Gallery

Sports Gallery

খেলাধুলার সব খবর, একসাথে হাতের মুঠোয়

তারকা পরিচয় | গ্যারিঞ্চা - দীপ্তাশিস দাসগুপ্ত

Share This



বিশ্বকাপ বহু তারকার জন্ম দিয়েছে। তাঁদের কৃতিত্ব আজ ও রাতের আকাশে নক্ষত্রের মত উজ্জ্বল। যাদের কথা আজ ও এক অদ্ভুত স্মৃতি মেদুরতায় মনকে আবিষ্ট করে। আজ এমন ই একজনের কথা বলব। যার অদ্ভুত পায়ের কাজ সারা বিশ্ব কে সম্মোহিত করে রাখত। তাঁর নাম Manuel Francisco dos Santos। চিনতে পারছেন কি? না চেনাই স্বাভাবিক। কারণ এই নামে তো তিনি জনপ্রিয় নন। কিন্তু যদি Garrincha নাম টা বলি তাহলে সবাই এক মুহূর্তে চিনে যাবেন তাঁকে। তিনি ব্রাজিল ফুটবলের স্বর্ণযুগের কাণ্ডারিদের একজন। 



যে ব্রাজিল দল ১৯৫৮ থেকে ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে তিন বার বিশ্বকাপ জয় করেছিল সেই দলের তিনি অন্যতম সদস্য। বিশেষত, ১৯৬২ তে চিলি বিশ্বকাপ এ পেলে আহত হবার পর মূলত তাঁর অসাধারণ দক্ষতার ওপর ভর করেই ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন হয়। ডিডি, ভাভা, আমেরিলদোর মতন দক্ষ ফুটবলার দের সাথে নিয়ে দুর্ধর্ষ ফুটবল উপহার দেন আপামর ফুটবল প্রেমী কে। ১৯৭০ এ অবশ্য ছিলেন না তিনি। মূলত মাঝমাঠের ফুটবলার। সেই Garrincha র কথাই আজ বলব। জন্ম ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ শে অক্টোবর। ব্রাজিলের রিও ডি জেনেইরো নামক রাজ্যে। তাঁর বাবা ছিলেন মদ্যপ, এবং তাঁর মধ্যেও সেই অভ্যাস সারাজীবন ধরে বর্তমান ছিল। একটা সময় অসাধারণ প্রতিভা থাকা স্বত্ত্বেও তাঁর পেশাদার ফুটবলে কোনও আগ্রহ ছিল না। শুধু তাই নয়, মানসিক ভাবে তিনি অত্যন্ত স্বাধীনচেতা ছিলেন। এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াতেই ভালবাসতেন, এবং যখন ইচ্ছে হতো, এখানে সেখানে ফুটবল খেলতেন।তাঁর Garrincha নাম টি দিয়েছিলেন তাঁর দিদি রোস।



২০ বছর বয়েসে তিনি বোটাফোগো ক্লাবে সই করেন এবং তাঁর অসামান্য ড্রিবলিং ক্ষমতার পরিচয় দেন। ১৯৫৭ সালে তিনি বোটাফোগো কে Campeonato Carioca খেতাব জেতান অসাধারণ খেলে। নিজেও ২৬ টি খেলাতে ২০ টি গোল করেন। এই দুর্দান্ত খেলার পর ব্রাজিলের জাতীয় দলের নির্বাচকরা ১৯৫৮ বিশ্বকাপে তাঁর নাম অন্তর্ভুক্ত করেন ব্রাজিল জাতীয় দলে। ১৯৫৮ বিশ্বকাপ আরম্ভ হবার এক মাস আগে ইতালির বিরুদ্ধে একটি গোল করেন, যা আজও অন্যতম সেরা গোল গুলোর একটি হিসেবে বিবেচিত হয়। ৪ জন ডিফেন্ডার ও গোলকিপার কে একাই নাস্তানাবুদ করে বল জালে ঢোকান। ১৯৫৮ বিশ্বকাপ এ এরপর সারা দুনিয়া কে বিস্মিত করে দেন তাঁর অসাধারণ পায়ের যাদুতে। সেই বিশ্বকাপে Soviet Union এর বিপক্ষে ব্রাজিলের খেলা ৩ মিনিটের একটা স্পেল আজ ও সর্বকালের সেরা ফুটবল স্পেল বলা হয়। এরপর ১৯৬২ তেও সেই একি পুনরাবৃত্তি। অসাধারণ ফুটবল খেলে আবার ও চ্যাম্পিয়ন করালেন ব্রাজিলকে। পেলের মত খেলোয়াড় না থাকা স্বত্ত্বেও। 



কিন্তু এইসময় থেকে ই অতুল মদ্যাসক্তির কারণে তাঁর ফুটবল জীবন বিঘ্নিত হতে শুরু করে। তাঁর ওজন বেড়ে যায়, এবং ম্যাচ ফিটনেস ও অনেক কমে যায়। বার বার পথ দুর্ঘটনার শিকার ও হন। বিশৃঙ্খল জীবন যাপন করার দরুন তাঁর পারিবারিক জীবনেও এর প্রভাব পরে। বলাই বাহুল্য, তাঁর মাঠের বাইরের জীবন ও মাঠের মধ্যেকার জীবনের মতই রঙিন। কিন্তু প্রতিভাবান রা তো বিশৃঙ্খল ই হন বহুক্ষেত্রে। কারণ তাঁদের কোনও গণ্ডি তে বেঁধে রাখা যায় না। ব্রাজিল এর জাতীয় দলের হয়ে ১৯৫৮ ও ১৯৬২ বিশ্বকাপ জেতা বা ১৯৫৫, ১৯৫৯ ও ১৯৬১ তে O'Higgins Cup জেতা, বা ১৯৬০ এ Oswaldo Cruz Cup জেতা, বা ব্রাজিল জাতীয় দলের হয়ে ৫০ টি খেলাতে ১২ টি গোল, বা ১৯৬২ তে Ballon D'or জেতা তো পরিসংখ্যান মাত্র। ক্লাব ফুটবলে খেলেছেন মোট ২৫৩ টি খেলা যার মধ্যে ২৩৬ বোটাফোগোর হয়ে, ৮৫ গোল করেছেন, সবকটি ই এই ক্লাব এর হয়ে। ১৯৬২ বিশ্বকাপ এ সোনার বল ও সোনার বুট দুটি খেতাব ই জেতেন। ক্লাব বোটাফোগোর হয়েও বহু খেতাব জেতেন। কিন্তু ওই যে বললাম, এসব নিছক ই পরিসংখ্যান। তাঁর আসল দক্ষতা তো ছিল অন্যখানে। তাঁর খেলা দেখতে মাঠে লোক ভিড় করত। গোল করার থেকে গোল করানো তেই বেশী মনোযোগ ছিল তাঁর। অসাধারণ সব ফ্রিকিক মারতেন।আধুনিক যুগের বানানা কিকের আসল জনক তিনি ই। অনায়াসে কাটাতে পারতেন বিপক্ষের একাধিক খেলোয়াড় কে। 



সামনে থাকা খেলোয়াড় দের নিখুঁত সব পাস দিতেন। শুধু তাই নয়, কর্নার থেকে পর্যন্ত সরাসরি গোল করতেন। তাঁর ড্রিবলিং ও ফুটবল বোধের দরুন দর্শক রা তাঁকে ডাকতো ' Joy of the people' বলে। তাঁর খেলার ধরণ ও ছিল তাঁর আচরণের মতন ই। সবকিছুর মধ্যেই একটা রাজকীয় আবেশ ছিল। এক ই সাথে ছিল শিশুর নিস্পাপ সারল্য। তাঁর খেলার মধ্যে কোথাও যেন একটা ছেলেখেলার প্রবণতা উপস্থিত। তাঁর মত অসাধারণ ফুটবলার, যে FIFA Player of the Century র তালিকাতে সপ্তম স্থানে থাকেন, ও FIFA World Cup All-Time Team এ যার নাম থাকে, তাঁর তো একটা নিজস্ব স্বত্বা থাকবেই। ১৯৮৩ র ২০ শে জানুয়ারি যখন Liver এ Cirrhosis এর কারণে তাঁর মৃত্যু হয়, তখন শয়ে শয়ে ফুটবল প্রেমী র চোখের জল, এবং তাঁর শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানে নামা মানুষের ঢল ই বুঝিয়ে দেয় তাঁর জায়গা আসলে কোথায়।তিনি যে ফুটবল প্রেমীদের হৃদয়ে নিজের নাম লিখে ফেলেছেন। "Here rests in peace the one who was the Joy of the People – Mané Garrincha.", তাঁর কবর এর উপর এই কথা টি আজ ও জ্বল জ্বল করেছে। এবং তাঁর সাথে দেওয়ালে লেখা Obrigado, Garrincha, por você ter vivido যার অর্থ Thank you, Garrincha, for having lived। আর সেই সঙ্গে উস্কে দিচ্ছে একটি বহু পুরনো প্রবাদ, 'Legends never die'। Legend দের মৃত্যু হয় না, তাঁরা মানুষের মনের আকাশে চিরকাল নক্ষত্র হয়ে বিরাজ করেন।

No comments:

Post a Comment

Pages