মৌপ্রিয়া ‘‌আত্মঘাতী’‌ | আজকাল - Sports Gallery

Sports Gallery

খেলাধুলার সব খবর, একসাথে হাতের মুঠোয়

মৌপ্রিয়া ‘‌আত্মঘাতী’‌ | আজকাল

Share This


অভীক রায়  মিল্টন সেন- বাংলার প্রতিভাবান ডাইভার মৌপ্রিয়া মিত্রের রহস্যমৃত্যু। সোমবার সকালে নিজের বাড়িতেই ঝুলন্ত অবস্থায় তাঁর দেহ উদ্ধার করা হয়। বাঁচানোর অনেক চেষ্টা করা হলেও লাভ হয়নি। আচমকা এই ঘটনায় হতবাক বাংলার ক্রীড়ামহল। সাম্প্রতিককালে ডাইভিংয়ে যথেষ্ট সাফল্য পেয়েছিল বাংলার এই প্রতিভাবান ডাইভার। কিন্তু কী কারণে জীবন শেষ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল সে, তা বুঝে উঠতে পারছেন না কেউই। শোকস্তব্ধ মৌপ্রিয়ার বাবা ভাস্কর মিত্র এবং মা শুভ্রা।
দিনটা শুরু হয়েছিল রোজকার মতোই। সকালবেলা তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে দুটো বিস্কুট এবং দুধ খেয়ে প্রতিদিনের মতোই চুঁচুড়াতে অনুশীলন করতে বেরোয় ব্যান্ডেলের প্রতিভাবান ডাইভার। ফিরে এসে মায়ের সঙ্গে চলে একপ্রস্থ খুনসুটি। এরপর ঠাকুমা বকুল মিত্রর সঙ্গেও কিছুক্ষণ গল্প করে মৌপ্রিয়া। রান্নাঘরে মেয়ের খাবার জন্য মাছভাজা বানাচ্ছিলেন মা। সেখানে গিয়ে নিজেও মাছ ভাজতে থাকে। খেয়েদেয়ে হেদুয়ায় অনুশীলনে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল মৌপ্রিয়া।

এমন সময় প্রবল ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়। নিচের ঘরে চলে যায় মৌপ্রিয়া। তার বাবা–মা অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলেন। বেশ কিছুক্ষণ পরে মেয়েকে খাওয়ার জন্য ডাকতে শুরু করেন মা। কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে ভাবেন মেয়ে বুঝি মজা করছে। নিচে নেমে দরজায় ধাক্কা দিয়েছিলেন মা। তৎক্ষণাৎ ভেজানো দরজা খুলে দেখা যায়, ওড়না দিয়ে ঝুলন্ত অবস্থায় মৌপ্রিয়ার দেহ। 
মেয়েকে ওই অবস্থায় দেখে চিৎকার করে ওঠেন বাবা–মা দু’‌জনেই। তাঁদের চিৎকারে জড়ো হয়ে যায় পাড়া–প্রতিবেশীরা। মেয়ের মুখে মুখ ঠেকিয়ে এবং বুকে চাপ দিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস চালানোর চেষ্টা করেন বাবা–মা। তাতেও কাজ না হওয়ায় স্থানীয় ইএসআই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানেই তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা। আকস্মিক এই ঘটনায় প্রবলভাবে ভেঙে পড়েন মৌপ্রিয়ার বাবা–মা। কী থেকে কী হয়ে গেল, বুঝে উঠতে পারছেন না কেউই। ফোনে মৌপ্রিয়ার মা কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, ‘‌সকালবেলাতেও প্র‌্যাকটিস করল। বাড়িতে এসে আমাদের সঙ্গে কত কথা বলল। ঠাকুমার সঙ্গে হাসিঠাট্টা করল। বকুনিও খেল। এর মাঝে ওর ভিতরে যে এরকম কোনও চিন্তাভাবনা চলছে, সেটা আমরা বুঝেই উঠতে পারিনি। কেন ও এরকম করল কেউ জানে না।’‌ কান্না ভেজা গলাতেই বলে দেন, ‘‌আগামী জুনে পুনেয় জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেওয়ার কথা ছিল ওর। আর কিছু হল না।’‌

সবথেকে বেশি ভেঙে পড়েছেন মৌপ্রিয়ার বাবা ভাস্কর মিত্র। খেলাপাগল মানুষটি একমাত্র মেয়েকে সবসময় উৎসাহ দিতেন। মেয়ের পিছনে সারাক্ষণ পড়ে থাকতেন। তাঁকে প্র‌্যাকটিসে নিয়ে যাওয়া, পড়াতে নিয়ে যাওয়া, যাবতীয় কাজকর্মেও ভাস্করবাবুর কোনও ক্লান্তি ছিল না। সর্বক্ষণ মেয়ের খেলাধুলোর খোঁজখবর রাখতেন। এমনকী, টুরিস্ট গাইডের যে চাকরি করতেন, সেটা পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছিলেন যাতে মেয়ের পিছনে আরও বেশি সময় দেওয়া যায়। বন্ধুর মতো মিশতেন মেয়ের সঙ্গে। আবদার রাখতে মেয়েকে মোবাইল কিনে দিয়েছিলেন। সোশ্যাল মিডিয়াতে থাকতে বাধা দেননি। কিন্তু নজর ছিল বরাবর। সকালেও অনুশীলন নিয়ে বাবার সঙ্গে অনেকক্ষণ মেয়ের কথা হয়। নিজের সাম্প্রতিক পারফরমেন্স নিয়ে মেয়ে একটু মনমরা ছিল। কিন্তু বাবা–ই তা কাটিয়ে দেন। মা শুভ্রা বলছিলেন, ‘‌সামনে জাতীয় প্রতিযোগিতা। সেটা নিয়েই আলোচনা চলছিল। যে করেই হোক সোনা পেতে হবে, মনে মনে এটার জন্যেই তৈরি হচ্ছিল। আর কিছুই হবে না।’‌ মৌপ্রিয়ার বাবা এতটাই ভেঙে পড়েছিলেন যে অনেক চেষ্টা করেও তাঁর সঙ্গে কথা বলা যায়নি।
পুলিস মনে করছে, প্রেমঘটিত সমস্যার কারণেই এমন চরম পথ বেছে নিয়েছে মৌপ্রিয়া। কিন্তু সে সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দিলেন মৌপ্রিয়ার মা–ই। স্পষ্ট বললেন, ‘‌হ্যাঁ, ওর সঙ্গে একটা ছেলের সম্পর্ক ছিল। কিন্তু আমরা সব মেনে নিয়েছিলাম। ওকে পুরোপুরি স্বাধীনতা দিয়েছিলাম। ছেলেটিও যথেষ্ট ভাল। আমার মেয়েকে উৎসাহ দিত। এরকম কোনও ঘটনা হতেই পারে না।’‌

সোমবার রাতেই মৌপ্রিয়ার দেহ ময়নাতদন্ত করা হয়। রিপোর্ট হাতে আসেনি। পুলিস রিপোর্ট হাতে পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। তবে প্রাথমিকভাবে পুলিসের অনুমান, এটা আত্মহত্যাই। আলাদা করে তদন্তও শুরু হয়েছে। মৌপ্রিয়ার এই কাণ্ডে হতবাক রাজ্য সাঁতার সংস্থার সচিব রামানুজ মুখোপাধ্যায়। বললেন, ‘‌ও শুধু বাংলার নয়, ভারতের অন্যতম সেরা ডাইভার ছিল। ওর আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পদক রয়েছে। আর দু’‌বছর গেলেই চাকরি পেয়ে পরিবারের সমস্যা দূর করতে পারত। তার আগেই একটা বাজে সিদ্ধান্ত নিল। খুব মর্মান্তিক।’‌
২০১৬–তে সাউথ এশিয়ান অ্যাকোয়াটিক চ্যাম্পিয়নশিপে হাইবোর্ডে সোনা এবং স্প্রিংবোর্ডে রুপো পেয়েছিল মৌপ্রিয়া। তার আগের বছর সিনিয়র ন্যাশনালে চতুর্থ এবং স্কুল গেমসে দ্বিতীয় হয়। সাধারণত যে বয়সে সাঁতার শুরু করে লোকে, তার অনেক পরেই সাঁতার শুরু করেছিল সে। চুঁচুড়ায় ড.‌ সুখেন্দু দাসের কাছে হাতেখড়ি হয়। কিছুদিন পর থেকে হেদুয়ায় সেন্ট্রাল সুইমিং পুলে তারকনাথ হাইত এবং নিমাই ভৌমিকের তত্ত্বাবধানে চলতে থাকে অনুশীলন। সপ্তাহে পাঁচদিন অনুশীলন চলত। ব্যস্ততার মধ্যেও পড়াশোনাতেও ছিল চৌখস। বছর দেড়েক আগে ‘‌আজকাল’‌–কে এক সাক্ষাৎকারে মৌপ্রিয়া জানিয়েছিল, অলিম্পিক পদকই তাঁর লক্ষ্য।
২০১৭–র ২৬ জানুয়ারি মুম্বইয়ের লোয়ার প্যারেলে নিজের ফ্ল্যাটে এভাবেই আত্মহত্যা করেছিলেন বাংলার আরেক নামী ডাইভার তনুকা ধাড়া। সে–খবর শুনে মৌপ্রিয়াই তখন বলেছিল, ‘‌তনুকাদি ভুল করল।’‌ কে জানত, সেই একই ভুল একদিন সে–ও করে ফেলবে!‌ বাংলার আকাশ থেকে অকালে ঝরে গেল আরও একটা প্রতিভা।‌‌‌‌

No comments:

Post a Comment

Pages